মাওলানা খান সাহেব ও তার “ছায়াছবির মত জগত”
“জগতটা আমার কাছে ছায়াছবির মত লাগে”
-মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
কেন জানিনা হঠাত করে মনে হল মাওলানা মুহিউদ্দিন খানের আত্মজীবনীটা যদি পড়া যেত। তখন লকডাউন চুড়ায়। সব বইপত্রের দোকান বন্ধ, আরে ভাই জীবন বাচে না। তর তর করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। প্রথম কিছুদিন এই ভাইরাস নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু এর মাঝেই কেন জানি মনে হইল মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের আত্মজীবনিটা পড়া উচিত। একদিন সারাসময় বইটার পিডীএফ খুজলাম। একে ওকে বললাম। নানা গ্রুপে বইটার পিডীএফ দিতে পারল বিকাশে নগদ পুরস্কার ঘোষণা করলাম। লাভ হইল না। ভিন্ন এক চেষ্টায় বইটা কিনে আনা গেল। ধন্যবাদ পূর্বাশা ডটকমকে।
শুরু করলাম। নাম “জীবনের খেলাঘরে”, নিচে তার স্বাক্ষরসহ নাম মুহিউদ্দীন খান। নামের আগে কোন টাইটেল নেই। অথচ তিনি তার পিতা থেকে যত ব্যক্তির নাম নিয়েছেন এই বইতে, তাদের নামের সাথে মাওলানা, শামসুল উলামা, মৌল্ভী, হেকিম, মণীষী, দানবীর ইত্যাদি শব্দ দিলেও নিজের নামের সাথে এমন কিছু জূড়ে না দেওয়ার ব্যাপারে তার কান খাড়া ছিল বলেই মনে হইল।
তার জন্ম পড়াশোনা মোমেনশাহিতে(ময়মনসিংহ) তে। উচ্চশিক্ষার জন্যে এসেছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায়। তার পরদাদা ডেঙ্গু খা কারামত আলি জৌনপুরির মুরিদ এবং তাদের বাড়িতে পীরসুফিদের আগমন তাকে ইলমে তাসাউউফ এবং তাযকিরাতের প্রতি আগ্রহী করে তুললেও তার প্রখর রাজনীতি-সচেতনতা তাকে একধরনের পলিটিকাল স্প্রিচুওয়ালিটির সন্ধান দিয়েছে। এর বড় উদাহরন তিনি থানভীর কিতাব এবং হাইলি পলিটিকাল মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কিতাব অনুবাদ করেছেন। চিরকাল জাতীয় রাজনীতিতে কাজ করে গেছেন তিনি। নানা ঐক্য-প্রচেষ্টায় এবং জাতীয় নানা আয়োজনের পরিচিত মুখ তিনি। উল্লেখ্য, খান সাহেব সৈয়দ আহমদ শহিদের বালাকোটের লড়াই দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত ছিলেন যে ‘জিহাদে’ শহিদ হয়েছিলেন আবুল মনসুর আহমদের দাদা অর্থাৎ মাহফুজ আনামের পরদাদা গাজি আশেকুল্লাহ।
যদিও আমি মনে করি বাংলা বানানের প্রতি তার অতি খচখচে স্বভাব মানুষের মধ্যমেধার পরিচায়ক। তবে তিনি আলেম-উলামাদের আরবি-ফারসি ছেড়ে বাংলায় ইসলাম-চর্চার তাগিদ দিলেও “শুদ্ধ প্রমিত বাংলা” না লেখার মত রাজনৈতিক সচেতনতা তার ছিল। তার গদ্যে প্রচুর “চালু বাংলা”র সাথে আরবি ফারসি ব্যবহার করেছেন। শাহবাগ সংকটের পর যখন মাদ্রাসার ছেলেপুলেরা প্রবলহারে ভার্চুয়াল দুনিয়ায় চলে এলো, তখন আমার মনে আছে এরা একেবারে রাবিন্দ্রিক-শামসুল হকদের ফোর্ট কলেজীয় ভাষার খপ্পরে পড়ে গেছিল। তখন অনেককে দেখেছি এদের সাবধান করার চেষ্টা করেছে। অথচ এদের পূর্বসুরিরা এ ব্যাপারে বেশ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
এ ব্যাপারে খানের(মুহিউদ্দিন খান) আত্মজীবনিতে একটি ঘটনা আছে। তখন ৬০ সালের শুরুতে কুরআনের বঙ্গানুবাদ হবে, তথ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে। কমিটিতে যুক্ত হলেন বাঘা বাঘা লোক ডঃ মু শহীদুল্লাহ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খা, আলিয়া মাদ্রাসার হেড মুহাদ্দিস বেলায়েত সাব, মাওলানা (যদিও নিজেকে তিনি কোথাও মাওলানা লিখতেন না) মুহিউদ্দিন খান।
তো মুহিউদ্দিন খান কুরআনের কিছু আয়াত বঙ্গানুবাদ করলে সেটাতে ভেটো দেন ডঃ মু শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, কুরআন এক মহান বানী আর তার ভাষা হইতে হইবে গুরুগম্ভীর-দ্যোতানপুর্ন। কিন্তু ইব্রাহিম খা আর মুহিউদ্দিন খান এর বিরুদ্ধে দাড়ায়ে বললেন, পাবলিক না বুঝলে এই দ্যোতনা কোন কাজে লাগবে না। কুরআন যদি পাঠের জন্যে হয় তাইলে তার ভাষা সকলের পাঠযোগ্য হইতে হবে। আল্লামা বেলায়েত ও তাদের যুক্তিতে সহমত জানালে ডঃ শহিদুল্লাহ এর অমতে সেভাবেই অনুবাদ হয়।
ইসলামি ধারায় সে এবং সাহিত্য ধারায় হুমায়ুনের এই “চালু বাংলায়” সাহিত্য-চিন্তার যোগসুত্র খুজতে গেলে মিল পাবেন, হাওড় অঞ্চলের পুথি সাহিত্য যা সেখানকার লেংটা-বুড়ার একমাত্র বিনোদনের উৎস ছিল। এছাড়া “মুসলমানি বাংলা’ বলে বাবুদের আলাদা করে দেওয়া চর্চিত বাংলার লোক ফররুখ, কবি তালেম হুসেনসহ অনের সাথে উঠাবসারও একটি প্রভাব খানের মধ্যে আছে।
তিনি রাজনীতিতে সারাজীবন নানাভাবে যুক্ত থাকলেও তার আত্মজীবনিতে এসেছে তার লেখালিখির জীবনকে প্রাধান্য করে। পিতা কংগ্রেসি ঘরানার দেওবন্দের উলামা দ্বারা প্রভাবিত হওায় পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু পিতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তবে তিনি মনে করতেন, মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে তাদের জযবা বেশি, সচেতনতা কম ছিল।
পূর্ব বাংলার মানুষেরাই আবেগ আর লড়াই দিয়ে পাকিস্তানকে নিয়ে এসেছিল। এদের আবেগ এই জায়গায় চলে গিয়েছিল যে, ৪৬ সালে যখন দেওবন্ধের হেড ওস্তাদ হোসাইন আহমদ মাদানি পূর্ববঙ্গের সৈয়দপুর এসেছিলেন এবং তিনি জমিয়তের নেতা হওায় ছিলেন পাকিসতান-বিরোধী। তার উপর হামলা হয় এবং তা পাগড়ি টেনে নেওয়া হয়।
খানের এই আত্মজীবনিতে তার অজস্র শিক্ষকের বন্দনা-বর্ণনা আছে। তবে এদের মধ্যে আমাকে যেই চরিত্রটি সবচেয়ে টানসে সেটা হল আল্লামা কাশগরি। তুর্কিস্তানে ছিল তার বাড়ি। সোভিয়েত আমলের কমিউনিস্ট অত্যাচারে পিতা-মাতা ছেড়ে চলে আসেন লক্ষনৌ নাদওয়ার মাদ্রসার বোর্ডিং এ। সেখান থেকে শেরে বাংলার অনুরোধে কলকাতা আলিয়া হয়ে পরে ঢাকা আলিয়ায় চলে আসেন। প্রায়ই বিড়ি ফুকতেন। শার্ট-প্যান্ট পড়তেন। কেউকে অতিরিক্ত সুফিয়ানা বেশ-ভুষায় দেখলে বলতেন, অল্পবয়সের সুফিয়ানা বেশিদিন টিকে না। চিরকাল অবিবাহিত ছিলেন। বিড়াল সঙ্গী করে বেচে থাকা এই মহাপ্রাণ ছিলেন আরবি ভাষার বিরাট পন্ডিত। আরবি কবিতার বই বের করেছিলেন। আধুনিক আরবি-বাংলা-উর্দু ভাষার এক বিরাট অভিধান তিনি লিখেছিলেন, নামঃ আল মুফিদ।
আমি ব্যক্তিগত জীবনে মাসিক মদিনা দিয়েই চিনেছি মাওলানা মুহিউদ্দিন খানকে। স্টেশনারি মানেই মাসিক মদীনা। তার আত্মজীবনীর পূর্ণতা তিনি দিতে চেয়েছেন মাসিক মদীনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের আইল ধরে। কিভাবে মাসিক মদীনাকে তিনি এই জায়গায় এনেছেন। পেয়েছেন নানা বাধা, এমনকি সমগোত্রীয়দের পক্ষ থেকেই।
তিনি লেখছেন, একবার তার পত্রিকায় একজন লেখা দিতে চায়। বিষয় হলঃ চাদে কেউ গেছে এটা বিশ্বাস করা যাবেনা, এটা ভাবাও কুফর। তিনি বললেন, এটা সম্ভব না। আমরা এটা ছাপাচ্ছি না আর এটা কুফরি কোন কথাও না। লোকটি তখন বলে ফেলে, এটা না ছাপালে প্রমান হবে আপনারাও কুফরের পক্ষে। কিন্তু এতে তিনি তেমন পাত্তা না দিলেও এরপর যখন বিজ্ঞাপনে একজন নারীর হাতের ছবি এল পত্রিকায়, তা অনেক মাদ্রসায় পর্যন্ত ঢুকতে পারেনি। আর তা পড়ার দায় অনেক ছেলের খাবার কেটে দিয়েছিল মাদ্রসা। এতে তিনি দমে যান নি। তিনি লেখেছেন, তার এমন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল এবং তিনি তা জানতেন। তিনি অবশ্য বলেন তার সফলতার সবই মদীনা নামের বরকত।
স্বাভাবিক পড়াশোনার বাইরে আমার আত্মজীবনী বেশ পছন্দের বিষয়। কিন্তু বেশিরভাগ আত্মজীবনী একেবারেই হিরোকেন্দ্রিক। কিন্তু খান সাহেব তার কম্প্যাসটি নিজের দিকে না রেখে নানা অচেনা চরিত্রের দিকে তাক করে পাঠককে বিস্তৃত এক ভুবনে নিয়ে গেছেন। এরকম অনুভব আমার হয়েছিল আরেকটি আত্মজীবনী পড়ে। সেটা হল “স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই” এর জন্মদাতা অনালোচিত সাংবাদিক নির্মল সেনের আত্মজীবনী “আমার জবানবন্দি”। আসলেই মাওলানা মুহিউদ্দিন জীবনকে ছায়াছবির মতই দেখতেন, তবে সেখানে তিনি নায়ক নন। নায়ক তৈরির কারিগর।